ক্রমেই সন্ধ্যা নামছে। আজ পূর্ণিমা। আকাশে এক প্রদীপ্ত চাঁদ উঠবে। রূপালী আলোয় এই পৃথিবী হবে জোৎস্নার প্রান্তর। মেহগনি পাতার ফাঁক দিয়ে পড়বে নকশাদার আলো।
বাতাসে হেমন্তের খড়ের গন্ধ। কৃষকের বউ চাটাই বিছিয়েছে দুয়ারে।
শিশুরা সেখানে চাঁদের আলোতে গোল্লাছুট খেলছে। আকাশের চাঁদ যেন শিশুটির সাথে হাটছে।
করিমন নেসা চাটাইয়ে বসে গল্প করছেন। চাঁদের আলোতে কারবালার কাহিনী। গভীর দরদ দিয়ে তিনি সুর টানছেন,
"তামশা দেখবার গেছলাম দুইভাই, হাম দরিয়ার পাড়ে,
চুরি কইরা নিছিন গা গো নিজাম সওদাগরে.."
ফিনিকফোটা জোসনায় বহুদূর থেকে শিয়াল আর হায়েনার ডাক শুনা যাচ্ছে৷
করিমন নেসা আবার শুরু করলেন,"হাটের চচ্চরী মাল গাছের বাইগুন, খাইয়া বেডা তালের নাছুন।"
নামাজ শেষ করে হাসেম দিঘির স্বচ্ছ জলধারার পাশে বসলেন আবুল হাসেম দপ্তরী। এই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রভাবশালী এই ব্যক্তিটির নব্বুইউর্ধ্ব বয়সেও তিনি যুবকের মত তেজোদ্দীপ্ত। তাঁর হাতে ক্রাচের তসবীহ।
পুকুরের পানিতে আকাশের ছায়া পড়েছে।
আবুল হাসেম বসে আছেন একটি কম বয়েসি ছেলের সাথে। ছেলের নাম জাফিন।
জাফিন তাকিয়ে আছে পুকুরের পানিতে। সেখানে দুলছে চাঁদ।
চাঁদনী রাতে চা বানিয়েছেন ঝর্ণা খানম। খুবই ভাল চা করেন তিনি। চা তিনি নিজেই নিয়ে আসছেন। দুটি চা। আবুল হাসেম চায়ে চুমুক দিচ্ছেন।
চাটাইয়ে লোক বাড়ছে। এবাড়ির সব নারী-শিশু যুক্ত হয়েছে চাঁদের নিচে।
দূরের বাতাসে ভাসছে মাইকের শব্দ, "ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইনাইলি রাজিওন। মৃত্যুকালে মরহুমের বয়স ... "
ফিনিকফোঁটা জোসনায়, এই সুন্দর পৃথিবী তাকে ছাড়তেই হলো। এখানে থাকা যায় না। এই গ্রহ আমাদের নয়।
সেকান্দর মুন্সী মসজিদের বারান্দায় বসে আছেন। মসজিদের সামনেই একটা বড় কামিনী ফুলের গাছ। ফুল ফুটেছে। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। সেকান্দর মুন্সী জিকির করছেন। মৃদু বাতাসে জিকিরের সুর অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। তিনি অন্ধ।হস্তশিল্প ভাল জানেন। হাতের রঙ্গন বাশের লাঠিটি চকলেট রঙের।
জাফিন খেলায় যোগ দিয়েছে। হাসেম দপ্তরী ডাকলেন, "জাফিন...জাফিন"
জাফিন দৌড়ে আসলো। তিনি পানি খাবেন। সাদা মেলামাইনের মগে পানি আনা হলো।
"বিসমিল্লাহ "। তিনি পান করলেন। "আলহামদুলিল্লাহ "।
" এই পৃথিবী থাকার যাগা না,আল্লাহ!" তিনি বললেন।
এই পৃথিবী তার সন্তানদের নিজের কাছ থেকে দূরে সরায় না। মানুষ মায়ের গর্ভ থেকে এসে যায় পৃথিবীর গর্ভে।
তাঁরাও নেই আজ। সেকান্দর মুন্সী নেই। হাসেম দপ্তরীর স্মৃতিময় বাড়িও আজ তার অনুপস্থিতিতে খাঁখাঁ করে।
চলে গেছেন করিমন নেসা। আজ রাতও ফিনিকফোঁটা জোসনা উঠেছে। শীতল পাটি আছে। সেই দুয়ার আছে। সেই মৃদু বাতাস আজও বয়ে যায়৷ পুকুরঘাট আছে। সেই কামিনী ফুলের গাছ আজো ফুলে ভরা।
শুধু নেই করিমন নেসা,আবুল হাসেম,সেকান্দর মুন্সী।