আপনার কথাগুলো এখানেই যায় যোগাযোগ Buy Now!

পরপর তিনটি অগ্নিকাণ্ড: "রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও সম্ভাব্য ষড়যন্ত্রের গভীর সংকেত”

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ের তিনটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড মিরপুরের রাসায়নিক ও গার্মেন্টস গুদাম (১৪ অক্টোবর ২০২৫), চট্টগ্রামের এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (CEPZ, ১৬ অক্টোবর ২০২৫), এবং শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলা (১৮ অক্টোবর ২০২৫) দেশের নাগরিক ও প্রশাসনিক পরিমণ্ডলে এক গভীর উদ্বেগের ঢেউ তুলেছে। তিনটি ঘটনা তিন ভিন্ন স্থানে ঘটলেও সময়ের ঘনত্ব, স্থানগুলোর কৌশলগত গুরুত্ব এবং আগুনের ধরন এমন এক মিলিত ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা নিছক ‘দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনা’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কাঠামো, শিল্প নীতি এবং প্রশাসনিক সতর্কতার উপর এক কঠিন প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছে।

চট্টগ্রামের CEPZ-এর সাততলা কারখানায় আগুন লাগার পর তা প্রায় সতের ঘণ্টা নিয়ন্ত্রণে আসেনি যা কেবল প্রযুক্তিগত ব্যর্থতা নয়, বরং ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা ও অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া সময়ের প্রতিফলন। শ্রমিকদের নিরাপত্তা, এক্সিট ডোর, অ্যালার্ম ও অগ্নি প্রতিরোধ ব্যবস্থা কার্যকর ছিল না এই তথ্যগুলো শুধু অবহেলা নয়, সম্ভাব্য নাশকতার সম্ভাবনাকেও জোরালো করে। মিরপুরের গার্মেন্টস ও রাসায়নিক গুদামে আগুনের ঘটনায়ও একই রকম ভয়াবহতা দেখা গেছে। লক করা দরজা, বিষাক্ত গ্যাসের উপস্থিতি এবং পর্যাপ্ত ফায়ার সেফটি ব্যবস্থার অনুপস্থিতি এসব প্রমাণ করে যে আগুনের কারণ কেবল দুর্ঘটনা নয়, বরং এর ভেতরে কোনো পরিকল্পিত বা অপরাধমূলক প্রস্তুতির ছাপ রয়ে গেছে। আর সর্বশেষ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলায় আগুন লাগার ঘটনা তো জাতীয় নিরাপত্তা, বিমান চলাচল এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের সুরক্ষাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছে। যেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সবচেয়ে কঠোর থাকার কথা, সেখানে আগুন লাগা নিঃসন্দেহে অস্বাভাবিক এটি রাষ্ট্রবিরোধী উদ্দেশ্যে সংঘটিত একটি “স্ট্র্যাটেজিক অ্যাটাক” হতে পারে বলেই শঙ্কা জাগে।

এমন ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ডকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখা অবিবেচনাপ্রসূত হবে। কারণ তিনটি ঘটনাই এমন স্থানে ঘটেছে, যা দেশের অর্থনীতি, শ্রমনির্ভর রপ্তানি খাত এবং আন্তর্জাতিক সংযোগের মূল স্তম্ভ। যদি কোনো গোষ্ঠী বা শক্তি সচেতনভাবে এই খাতগুলিতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে চায়, তাহলে তা কেবল অপরাধ নয়, রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড যার লক্ষ্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক আত্মবিশ্বাসকে দুর্বল করা এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলা।

এখন প্রয়োজন একটি পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ জাতীয় তদন্ত। আমরা স্পষ্টভাবে দাবি করছি (১) অবিলম্বে একটি স্বাধীন জাতীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হোক, যাতে অগ্নি-ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ, শিল্প নিরাপত্তা বিশ্লেষক, আইনবিদ, গোয়েন্দা কর্মকর্তা, শ্রমিক প্রতিনিধি ও নাগরিক সমাজের সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত থাকবেন; (২) প্রতিটি ঘটনার ফরেনসিক ও প্রযুক্তিগত তথ্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ করা হোক; (৩) সিসিটিভি ফুটেজ, মালিকানা দলিল, শ্রমিকদের সাক্ষ্য এবং ফায়ার সার্ভিসের প্রতিক্রিয়া সময় সব কিছু নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা হোক; (৪) দোষী প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

একইসাথে সরকারকে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক ও পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে। তাৎক্ষণিক চিকিৎসা সহায়তা, আর্থিক অনুদান এবং দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিপূরণ কাঠামো নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক ও সাংবিধানিক দায়িত্ব। কারণ, জনগণের জানমাল রক্ষা কেবল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ নয় এটি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষার শর্ত।

এই অগ্নিকাণ্ডগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা শুধুমাত্র সীমান্তরক্ষায় সীমাবদ্ধ নয়; অর্থনৈতিক কেন্দ্র, শিল্প এলাকা ও কৌশলগত অবকাঠামোগুলোও এখন নিরাপত্তার অগ্রাধিকার হতে হবে। অর্থনীতি, অবকাঠামো ও জনবিশ্বাসকে লক্ষ্য করে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডগুলো এক ধরনের “অর্থনৈতিক সন্ত্রাসবাদ” বা “ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল সাবোটাজ” যা বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের আধুনিক কৌশল হিসেবে বিবেচিত। তাই এই ঘটনাগুলোকে নিছক দুর্ঘটনা ভেবে দায়সারা বক্তব্যে থামা মানেই অপরাধকে প্রশ্রয় দেওয়া।

অতএব, এখনই সময় সত্য উদঘাটনের, দায় নির্ধারণের এবং ন্যায়বিচারের মাধ্যমে জনগণকে আশ্বস্ত করার। বাংলাদেশকে প্রমাণ করতে হবে যে আগুন আমাদের দগ্ধ করে, সেই আগুন থেকেই আমরা আলোর উৎস খুঁজে নিতে পারি। দোষীদের বিচার ও ক্ষতিগ্রস্তদের পূর্ণ পুনর্বাসনের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে জানাতে হবে এই দেশ কোনো ষড়যন্ত্রের আগুনে পুড়ে ধ্বংস হবে না; বরং ন্যায়, জবাবদিহিতা ও জনগণের আস্থার শক্তিতেই দৃঢ়ভাবে টিকে থাকবে।

লেখক


আল আমিন হিজাযী 
সাবেক সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক, 
নোঙর সাংস্কৃতিক সংসদ-ময়মনসিংহ জেলা 
কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য, 
স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ বাংলাদেশ

Post a Comment

বিস্কুট নীতি
আপনার অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি, ট্রাফিক বিশ্লেষণ ও ব্রাউজিং আনন্দময় করতে আমাদের বিস্কুট নীতিতে সম্মত হোন।
ইস!
মনে হচ্ছে আপনার নেট সংযোগে সমস্যা হয়েছে। একটু চেক করবেন কী?
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.